.
আগষ্ট এর ৫ তারিখে বাংলাদেশে গণ-আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যায় সাবেক সরকার প্রধান ফ্যাসিস্ট হাসিনা।হাসিনা পালানোর পর থেকেই নানান ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগ দেশকে অস্থিতিশীল করছে বারবার।এর মধ্যেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় সমাবেশ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে দাবি করেছেন বৈষম্য-বিরোধী ছাত্র আনন্দোলনের নেতারা।ওই সমাবেশে সাবেক প্রধানমন্ত্রী হাসিনা অংশ নিতে পারেন বলেও তথ্য দিয়েছেন তারা।
শনিবার সন্ধ্যায় নোয়াখালীতে এক অনুষ্ঠানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আনন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসুদ বলেন “ওই সমাবেশ থেকে তারা (আওয়ামী লীগ) একটি প্রবাসী সরকারের ঘোষণা দিতে এবং হাসিনাকে সেখানে নিজে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখতে পারেন বলে তথ্য রয়েছে,”একই তথ্য দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। তিনি আরও বলেন “পালিয়ে গিয়েও খুনি হাসিনা দেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করছেন,।” এবং “আমরা ফ্যাসিবাদের গংদের স্পষ্টভাষায় বলে দিতে চাই, তাদের ষড়যন্ত্র ও অপচেষ্টা কখনোই বাংলার মাটিতে সফল হবে না,” বলেও হুশিয়ারি দেন।
গত কয়েকদিন ধরে বিষয়টি নিয়ে কথাবার্তা হলেও, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্বশীল কেউ এখনও এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।
সমন্বয়করা এমন একটি সময় এ ধরনের বক্তব্য দিলেন যখন ‘গণহত্যার’ অভিযোগে বেশকিছু রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তোলা হয়েছে।এমনকি, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে যে, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের অংশগ্রহণে বাধা দেওয়া হবে।
ফলে টিকে থাকতে দলটি সত্যিই ভারতের মাটিতে সমাবেশ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে কী-না, সেটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে বেশ আলোচনা হতে দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু আওয়ামী লীগ আসলেই কি আগরতলায় সমাবেশ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে?
দলটি যদি সমাবেশের প্রস্তুতি নেয়ও, ভারত সরকার কি ওই ধরনের দলীয় কর্মসূচি করার অনুমতি দেবে?
এমন দাবির ভিত্তি কি?
সমন্বয়কেরা বলছেন, তাদের কাছে তথ্য রয়েছে যে ভারতের মাটিতে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা সমাবেশ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।কিন্তু প্রশ্ন হলো এমন তথ্য তারা পেলেন কোথা থেকে?
বিবিসি বাংলাকে উত্তরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসুদ বলেন “আমাদের নিজস্ব কানেকশনের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি”,সমাবেশ করার বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে আওয়ামী লীগ তাদের নেতারা ইতোমধ্যে তৎপরতা শুরু করেছেন বলেও দাবি করেন এই সমন্বয়ক।
কিন্তু, বাংলাদেশে যেখানে স্বাধীন-সার্বভৌম একটি দেশ এবং আওয়ামী লীগ কোনো ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ গোষ্ঠী নয়, সেখানে তারা কেন প্রবাসী সরকার ঘোষণা করতে যাবে? এমন প্রশ্ন রাখা হলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা তার জবাব দিয়েছেন।জনাব মাসুদ বলছিলেন, “বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ, কিন্তু তারা নিজেরা তো এখান থেকে পদত্যাগ করে গণঅভ্যুত্থান-গণবিপ্লবের মুখে জনরোষ থেকে বাঁচতে পালিয়েছে।”
“মানুষ রক্ত দিয়ে এখন যে সরকারকে বসিয়েছে, তারা সেই সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে চাচ্ছে। এ কারণেই তারা এমন উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে,” বলেন তিনি।গত পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ বিভিন্ন সময় জানিয়েছেন যে, তার মা আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেননি।ফলে আওয়ামী লীগ সভাপতিই এখনও বাংলাদেশের ‘বৈধ প্রধানমন্ত্রী’ বলেও মন্তব্য করেন মি. ওয়াজেদ।
সমন্বয়ক মাসুদ দাবি করেছেন, “এরকম আলোচনা সামনে এনে এখন শেখ হাসিনা বিভিন্ন দেশে সফর করে নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করে পুনরায় সংগঠিত হওয়ার চেষ্টার পরিকল্পনা করছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।”বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকারকেও জানানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন এই সমন্বয়ক।
আওয়ামী লীগ এর বক্তব্য কি?
ভারতের মাটিতে সমাবেশ ও প্রবাসী সরকার ঘোষণা করতে যাচ্ছে বলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুইজন সমন্বয়ক যে দাবি করেছেন, তার কোনো ভিত্তি নেই বলে বলছেন আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা।আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “এগুলো সব ভিত্তিহীন, অসত্য এবং প্রোপাগান্ডা।”
অন্তর্বর্তী সরকার এখন দেশ চালাতে পারছে না “দেশে এখন জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা বলে কিছু নেই, আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে, অরাজকতা চলছে। মোটকথা, কোনোকিছুর উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ নেই,” বলছিলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের সিনিয়র আরেকজন নেতা।অবশ্য সাথে স্বীকার করেন, নেতাকর্মীদের অনেকে যে ইতোমধ্যে দেশ ছেড়েছেন এবং এখনও ছাড়ার চেষ্টা করছেন।
তিনি বলেন “আমাদের নেতাকর্মীদের উপর যেভাবে অত্যাচার-নির্যাতন-মামলা-হামলা চালানো হচ্ছে, তাতে করে জীবন বাঁচাতে কেউ যদি দেশের বাইরে আশ্রয় নেয়, সেটা কি সে পারে না?,”
ভারতের বক্তব্য!
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের দাবিকে সম্পূর্ণ “ভিত্তিহীন” বলে উড়িয়ে দিয়েছেন ভারত সরকারের কর্মকর্তারা।ভারত অবশ্য বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছে না বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
“কারা বলছেন এসব কথা? তারা কি কোনও দায়িত্বপূর্ণ পদে আছেন? এই প্রশ্ন রেখে বলেন পাশের দেশে যে কেউ একটা কথা বললেই আমরা কেন জবাব দিতে যাবো?” ভারত সরকারের একটি সূত্র এভাবেই বিবিসি বাংলাকে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন ।এ ধরনের দাবির যে কোনও ভিত্তি নেই।
প্রথমত, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পালিয়ে আসা নেতা-কর্মীরা যদি ত্রিপুরার মাটিতে বড় মাপের কোনও সমাবেশ করতে চান, সেটা একেবারে গোপনে বা স্থানীয়দের কাউকে টের পেতে না-দিয়ে করা সম্ভব নয়।ত্রিপুরার সরকারি ও বেসরকারি একাধিক সূত্র বিবিসিকে নিশ্চিত করেছে, রাজধানী আগরতলায় এ ধরনের কোনও তৎপরতা গত কয়েক সপ্তাহে তাদের আদৌ চোখে পড়েনি।
দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগ যদি ভারতের মাটিতে কোনও প্রকাশ্য সভা করেও, সেখানে ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনাকে ভাষণ দিতে দেওয়া হবে- সে সম্ভাবনা একেবারেই নেই।
গত আড়াই মাসে ভারত বারেবারে এটা স্পষ্ট করে দিয়েছে, এক বিশেষ পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে নিজের সুরক্ষার জন্য শেখ হাসিনাকে ভারতে চলে আসতে হয়েছে এবং তখন তাকে আতিথেয়তা দেওয়া হয়েছে।এই পরিস্থিতিতে তাকে প্রকাশ্য রাজনীতিতে অংশ নিতে দেওয়া হবে, ভারত এখনও এরকম কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি।ফলে প্রকাশ্য কোনও রাজনৈতিক সভায় তিনি ভাষণ দিলে, বা তার অডিও বার্তা প্রচার করা হলে দিল্লির জন্য তা কূটনৈতিকভাবে খুবই অস্বস্তিকর হবে।
পাঁচই অগাস্টের পালাবদলের পর আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মী পালিয়ে ভারতে চলে এসেছেন এদের অনেকেরই আগে থেকে ভারতের ভিসা ছিল, কেউ কেউ আবার এসেছেন ‘বিশেষ ব্যস্থায়’।বিবিসি জানতে পেরেছে,ভারত তাদের সবাইকেই অনানুষ্ঠানিকভাবে ‘লো প্রোফাইল’ বজায় রেখে চলার নির্দেশ দিয়েছে – প্রকাশ্য কোনও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়াতেও নিষেধ করা হয়েছে তাদের।
বিবিসি’র শুভজ্যোতি ঘোষের সঙ্গে একান্ত আলোচনায় ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি পদস্থ সূত্র বলেছেন, “আওয়ামী লীগ ভারতের মাটিতে শক্তি সঞ্চয় করে বাংলাদেশে ফিরে আসতে চাইছে, এজন্যই সীমান্তের খুব কাছে সভা-সমাবেশ করছে – বাংলাদেশের মানুষকে আওয়ামী জুজু দেখাতেই এগুলো বলা, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। আমাদের সেই ফাঁদে পা-দেওয়ার কোনও কারণ নেই!” সূত্র : বিবিসি বাংলা।